২১ নভেম্বর, ২০২৫

প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে খাবার চায় শিশু দুটি, তাই শিকলে বেঁধে রাখছেন মা–বাবা

প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে খাবার চায় শিশু দুটি, তাই শিকলে বেঁধে রাখছেন মা–বাবা
রান্নাঘরের খুঁটির সঙ্গে শিশু সিমন হোসেনের পা শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। সামনে সিমনের ভাই ইবল ও বোন আমবিয়া। বদরগঞ্জ পৌরসভার পকিহানা গ্রামের রেলবস্তিরছবি: ইছামতী টিভি কয়েক দিন পরেই ঈদ। এ উপলক্ষে সন্তানদের নতুন জামাকাপড় কিনে দিচ্ছেন বাবা–মায়েরা। শিশুরা আনন্দ নিয়ে অপেক্ষা করছেন নতুন পোশাক পরে ঈদের দিন ঘুরে বেড়ানোর। অথচ রংপুরের বদরগঞ্জ পৌরসভার পকিহানা গ্রামের রেলবস্তির দুই শিশু সহোদরের জীবনে আনন্দ নেই। শিকলে বাঁধা অবস্থায় কাটছে তাঁদের জীবন। ওই দুই শিশুর নাম সুমন হোসেন (১০) ও সিমন হোসেন (৮)।
তাঁদের মা–বাবা ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দরিদ্র ওই পরিবারের সদস্যদের অনাহারে–অর্ধাহারে দিন কাটে। ক্ষুধার জ্বালায় সুমন ও সিমন বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেশীদের বাড়িতে গিয়ে খাবার চায়, কখনোবা গোপনে গাছের ফল ছিঁড়ে নিয়ে আসে। এসব কারণে প্রতিবেশীদের কথা শুনতে হয় তাঁদের মা–বাবাকে। তাই সুমনকে ছয় মাস ধরে এবং সিমনকে ১৫ দিন ধরে ঝুপড়ির উঠানে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখেছেন মা–বাবা।
সুমন–সিমনের বাবা আমির হোসেন (৬০) বাজারে গরু কেনাবেচায় মধ্যস্থতাকারীর কাজ করেন। মা শেফালী বেগম (৩২) গৃহিণী। দরিদ্র এ পরিবারের নেই কোনো জমিজমা। রেল বস্তিতে টিনে ঘেরা ছোট্ট একটি ঝুঁপড়িতে বসবাস তাঁদের।
প্রতিবেশী এক ব্যক্তির কাছ থেকে খবর পাওয়ার পর গতকাল রোববার বিকেলে ওই রেল বস্তিতে শিশু দুটির ঘরে গিয়ে প্রথমে কাউকে পাওয়া যায়নি। কিন্তু পাশ থেকে কান্নার আওয়াজ কানে আসছিল। এরপর উঁকি দিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট রান্নাঘরের ভেতরে একটি শিশুর পা শিকল দিয়ে বাঁশের খুঁটির সঙ্গে বাঁধা। শিশুটি জানায়, তার নাম সিমন হোসেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁর মা শেফালী বেগম এক হাতে শিকল ধরে শিশু সুমন হোসেনকে নিয়ে বাড়িতে ঢোকেন। সিমনের এক পা শিকলে বাঁধা, তালা লাগানো। কিছুক্ষণ পর ঘরে ঢোকে শেফালীর আরও দুই সন্তান ইবল হোসেন (৬) ও আমবিয়া খাতুন (৬)। তাঁদের মুক্ত অবস্থায়ই ঘুরতে দেখা যায়।জানতে চাইলে শেফালী বেগম বলেন, ‘সারা দিন বান্ধা (শিকলে বাঁধা) থাকে। পাশের বাড়িত গেচনু সাথে ধরি (সুমনকে নিয়ে)। পায়ের শিকল শক্ত করি ধরি থাকো। না হইলে পালে যায়। মানুষের কথা সহ্য করতে করতে জীবনটা মোর শ্যাষ হয়া গেইচে। সেই জন্য ছয় মাস ধাকি এইটাক (সুমন) পাওত ঝিঞ্জির (শিকল) নাগে বান্দি ধুচি। যেন মানুষের বাড়িত যায়া কাকো বিরক্ত না করে। কারও জিনিস না নাড়ে। ছোটটাক (সিমন হোসেনকে) বান্দি থুচি ১৫ দিন থাকি। মোর ছইল দুইটার জন্যে বস্তির মানুষের শান্তি নাকি উটি গেইচে। মোর ছইল দুইটায় কষ্ট পাউক তাও ওঁরা (বস্তিবাসী) শান্তিক থাউক।’

কেন বস্তিবাসীকে বিরক্ত করে জানতে চাইলে শেফালী বেগম কাঁদতে থাকেন। একপর্যায়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘হামরা ছইল ছোটোয় (স্বামী–স্ত্রী–সন্তানসহ) একরাইশ (অনেক) মানুষ। লোকটা (স্বামী) ঠিকঠাক কাম করে না। ছোটো ছইল থাকায় মোক কাঁয়ো কামোত নেয় না। ঘরোত খাবার থাকে না। ছইলেরা না খায়া থাকে। ভোক (খিদে) সহ্য করতে না পারি সুমন ও সিমন বস্তির মানুষোক জ্বালায়, খাবার চায়, না কয়া গাছের ফল ছিঁড়ি আনে। কারও কিছু হারাইলে ওমার দুই ভাইয়ের (সুমন ও সিমনের) দোষ দেয়। চুরি হওয়া জিনিস মোরটে চায়। কোনটে পাও মুই জিনিস। কত আর সহ্য করা যায়!’
এদিনও ঘরে কোনো খাবার ছিল না। ছোট ছোট শিশুসন্তানেরা সকাল থেকে ক্ষুধার জ্বালায় কান্নাকাটি করছিল, জানান শেফালী বেগম। এ সময় রান্নাঘরের খুঁটির সঙ্গে শিকলে বাঁধা সিমনের পাশে ঘুমিয়েছিল ছয় বছরের একটি শিশু। জানা গেল, তার নাম আমবিয়া খাতুন। সিমনের ছোট বোন। ক্ষুধায় কান্নাকাটি করে ঘুমিয়ে পড়েছে সে।
প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, আমির হোসেনের দুই স্ত্রী। প্রথম স্ত্রীর ছয় ছেলে ও এক মেয়ে এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর চার ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। অভাবের কারণে সাত সন্তান নিয়ে ১৫ বছর আগে প্রথম স্ত্রী চলে যান ঢাকায়। এরপর থেকে দ্বিতীয় স্ত্রী শেফালী বেগমকে নিয়ে রেল বস্তিতে বাস করছেন আমির হোসেন। আমির-শেফালীর সন্তান ছিল আটজন। এর মধ্যে প্রসবের সময় যমজ দুই ছেলে মারা যায়। তিন বছর আগে পাঁচ দিনের এক ছেলে সন্তানকে জিয়াদুল নামের এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। তাঁদের ঘরে এখন পাঁচ সন্তান রয়েছে। অভাবের কারণে বাচ্চাদের লেখাপড়া করাতেও পারছেন না এই দম্পতি।
শেফালী বেগম বলেন, তাঁর স্বামী আগে দিনমজুরি করতেন। এখন বয়স বেশি হওয়ায় ভারী কাজকর্ম করতে পারেন না। বদরগঞ্জ পৌরসভার হাটে সপ্তাহে দুই দিন (সোম ও বৃহস্পতিবার) গরু বিক্রির মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেন। এতে দুই থেকে চার শ টাকা পেলে খাবার জোটে। না পেলে অনাহারে কাটে।

এ সময় কথা হয় আমির হোসেনের সঙ্গে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছইলেরা ক্ষিদার জ্বালায় এর–ওর বাড়িত যাইত। এইটা নিয়া অনেক কথা শুনতে হইত। তাই ওদের মা পায়ে ঝিনজির (শিকল) নাগেয়া বান্দি (বেঁধে) থুইচে।’
প্রতিবেশি শরিফা খাতুন বলেন, ‘আমির হোসেনের স্ত্রী ও সন্তানগুলোর খুব কষ্ট। বাপ–মায়ের আয় না থাকায় বেশির ভাগ সময়ে তাঁরা না খেয়ে থাকে। অবুঝ সন্তানগুলোর কান্নাকাটি দেখে খারাপ লাগে। মাঝেমধ্যে ওদের খাবার দেওয়ার চেষ্টা করি।’ শরিফা খাতুন আরও বলেন, আমির হোসেন ও শেফালীর জন্য কোনো কাজের ব্যবস্থা করে দিলে ভালো হয়। এ ছাড়া ওদের জন্য সরকার একটা ঘর দিলে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়।

এ বিষয়ে সোমবার দুপুরে মুঠোফোনে কথা হয় বদরগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আবু সাঈদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঘটনাটি আমার জানা ছিল না। এটা একেবারেই অমানবিক। খোঁজ নিয়ে দ্রুতই ওই দুই শিশুকে মুক্ত করার এবং পরিবারটির জন্য খাবারের ব্যবস্থা করব।’

Share on facebook
Facebook
Share on twitter
Twitter
Share on whatsapp
WhatsApp
Share on linkedin
LinkedIn
Share on skype
Skype
Share on email
Email

আরো সংবাদ পড়ুন

সংবাদ আর্কাইভ

সোম মঙ্গল বুধ বৃহ শুক্র শনি রবি
 
১০১১১২১৩১৪১৫১৬
১৭১৮১৯২০২১২২২৩
২৪২৫২৬২৭২৮২৯৩০

বিভাগীয় সংবাদ